পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী সংকট: পাকিস্তান কি টিকে থাকতে পারবে?
বর্তমানে পাকিস্তান এক ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটের মুখোমুখি। পাকিস্তানের সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ দেশটি চারটি ভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের দ্বারা একযোগভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এই সংগঠনগুলি হলো: তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (TTP), বালুচ লিবারেশন আর্মি (BLA), ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসান (ISIS-K), এবং আফগানিস্তানের তালিবান। এই সংগঠনগুলি একে অপরের থেকে আলাদা হলেও, তারা একত্রে পাকিস্তানকে আক্রমণ করছে এবং দেশটির নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই সঙ্কটের সমাধানে পাকিস্তান কি সফল হতে পারবে?
পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী সংকট
বর্তমানে পাকিস্তান এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে, দেশটি সন্ত্রাসী আক্রমণগুলির উত্থান দেখেছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী একাধিক সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তবে এই সংগঠনগুলির একযোগভাবে আক্রমণ চালানোর কারণে তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
চারটি প্রধান সন্ত্রাসী সংগঠন
পাকিস্তানে বর্তমানে যে চারটি প্রধান সন্ত্রাসী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, সেগুলি হচ্ছে:
- তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (TTP): এটি পাকিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী তালিবান সংস্থা। আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের পুনরুত্থান পাকিস্তানে TTP-র কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
- বালুচ লিবারেশন আর্মি (BLA): বালুচিস্তানে এই সংগঠনটি অত্যন্ত সক্রিয়, এবং তারা চীনা প্রকল্পগুলির উপর আক্রমণ চালায়।
- ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসান (ISIS-K): এটি পাকিস্তানে একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন, যা আফগানিস্তানে তালিবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখানে তাদের আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- আফগানিস্তানের তালিবান: যদিও তালিবান সরাসরি পাকিস্তানে আক্রমণ করছে না, তাদের সমর্থনে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল টেররিজম ইনডেক্সে পাকিস্তান
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত তথ্যের সূচক (Global Terrorism Index) ২০২৫ এ পাকিস্তানকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সন্ত্রাসী প্রভাবিত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০২৪ সালে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত মৃত্যু সংখ্যা ছিল ১০৮১, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৩৩৩টি বেশি। এই উত্থানটি প্রধানত TTP ও BLA-র কারণে হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী সংগঠন পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একাধিক আক্রমণ চালাচ্ছে, যার ফলে দেশটির সামরিক বাহিনী কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
পাকিস্তান সরকারের পদক্ষেপ
পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে এই পদক্ষেপগুলো এখনও কার্যকরী হয়ে উঠেনি। সামরিক বাহিনী বিভিন্ন আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করছে, যার ফলে পাকিস্তান সরকার তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
পাকিস্তানের বিপদে চীন ও ভারত
পাকিস্তানকে চীনের সমর্থন প্রয়োজন, বিশেষত CPEC (China-Pakistan Economic Corridor) প্রকল্পের জন্য, কিন্তু পাকিস্তানে চলমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে চীনও সম্ভবত তাদের সহায়তা সীমিত করতে পারে। পাশাপাশি, ভারত পাকিস্তানের প্রধান প্রতিবেশী এবং নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে রয়েছে। যদিও ভারত পাকিস্তানের এই সংকটকে উপেক্ষা করতে চায়, তবে পাকিস্তান যদি স্থিতিশীল না থাকে, তাহলে তার প্রভাব ভারত ও অন্যান্য অঞ্চলের উপর পড়বে।
পাকিস্তান কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করতে পারে?
পাকিস্তান যদি এই সন্ত্রাসী সংকট থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাহলে তাকে কিছু প্রধান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:
-
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: পাকিস্তানকে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তারা পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানকে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সহায়তা নিতে হবে।
-
ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং: পাকিস্তানকে তার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে, বিশেষ করে ভারত ও চীন, ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং করতে হবে। এতে করে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির গতিবিধি দ্রুত ট্র্যাক করা সম্ভব হবে।
-
সামরিক ও সামাজিক কৌশল: পাকিস্তানকে শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অশিক্ষা এসবের মূল কারণ হতে পারে, তাই এগুলির মোকাবিলা করাও প্রয়োজন।
-
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা: পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে সামাজিক সেবা এবং আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ: কী হতে পারে?
পাকিস্তান যদি এ সমস্ত পদক্ষেপ নিতে না পারে, তবে দেশটি আরও গভীর নিরাপত্তা সংকটে পড়তে পারে। এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো বাড়বে। বিশেষত, বালুচিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনখোয়া অঞ্চলে যদি অস্থিরতা বাড়ে, তাহলে পাকিস্তান আরও বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে।
পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে একটি সমন্বিত এবং সুসংগঠিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে করে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে মোকাবিলা করা যায়। যদি পাকিস্তান এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য স্থিতিশীলতার একটি উদাহরণ হতে পারে। তবে পাকিস্তান যদি এই সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তবে তার প্রভাব কেবল পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সারা অঞ্চলের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে তা প্রভাব ফেলবে।