ইয়েমেনে মার্কিন বিমান হামলা: মধ্য প্রাচ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি

Your paragraph text 5

মার্কিন বিমান হামলা ও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহ: বৈশ্বিক সংকটের নতুন মাত্রা

মধ্য প্রাচ্যের অস্থির রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়ালো ইয়েমেনে মার্কিন বিমান হামলার মধ্য দিয়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী ঘাঁটিতে চালানো হয়েছে ব্যাপক বিমান হামলা। এই অভিযানের পেছনে মূল কারণ রেড সি ও এডেন উপসাগরে হুথিদের জাহাজ হামলা, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তবে এই সংঘাত শুধু ইয়েমেন বা হুথিদের মধ্যে সীমিত নেই—এটি ইরান-ইসরাইল-আমেরিকার প্রভাবের লড়াই, ফিলিস্তিন ইস্যু, এবং আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের নিরাপত্তা নিয়ে জটিল এক গোলকধাঁধা।

হুথিরা কারা? ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’-এর হাতিয়ার

হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের শিয়া জাইদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। ১৯৯০-এর দশকে হুসাইন আল-হুথির নেতৃত্বে তাদের উত্থান। শুরুতে স্থানীয় সুন্নি সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও ২০১৪ সালে তারা রাজধানী সানাসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চল দখল করে। এরপর থেকে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে তাদের যুদ্ধে ইয়েমেন পরিণত হয়েছে “বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটে”।

ইরানের সম্পৃক্ততা: হুথিরা ইরানের “প্রতিরোধ অক্ষ” (Axis of Resistance)-এর অঙ্গ। এই অক্ষে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস, ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া, এবং সিরিয়ার আসাদ সরকার। ইরান থেকে অস্ত্র, অর্থ, ও প্রশিক্ষণ পেয়ে হুথিরা পশ্চিমা শক্তি ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রোক্সি যুদ্ধ চালায়।

কেন হুথিদের লক্ষ্য করে মার্কিন হামলা?

গত অক্টোবরে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর হুথিরা ইসরাইলি জাহাজ ও পশ্চিমা স্বার্থে হামলা বাড়ায়। তাদের ড্রোন-মিসাইল আক্রমণের শিকার হয়েছে রেড সি ও এডেন উপসাগরের ১২টি বাণিজ্যিক জাহাজ। এই হামলার পেছনে হুথিদের দাবি: “ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ইসরাইলকে চাপে রাখা।” কিন্তু এর গ্লোবাল প্রভাব বিশাল:

  1. বাণিজ্যিক বিপর্যয়: রেড সি দিয়ে বিশ্বের ১৫% সামুদ্রিক বাণিজ্য হয়, যার ৩০% জ্বালানি পরিবহন। হামলার ভয়ে জাহাজগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে যাচ্ছে, যা সময় ও খরচ বাড়াচ্ছে ৪০%।
  2. মার্কিন নৌশক্তি চ্যালেঞ্জ: হুথিরা সরাসরি মার্কিন জাহাজে হামলা চালালে ট্রাম্প প্রশাসন “নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে” কঠোর পদক্ষেপ নেয়।

ট্রাম্পের বক্তব্য: “সন্ত্রাসীরা আমেরিকান স্বার্থকে থামাতে পারবে না। হুথিদের সময় ফুরিয়েছে।”

হামলার বিস্তারিত: কোথায় কী আঘাত হানা হয়েছে?

মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি এস. ট্রুম্যান থেকে F/A-১৮ সুপার হর্নেট যুদ্ধবিমান, ব্রিটিশ টর্নেডো জেট, এবং সাবমেরিন থেকে টমাহ্যawk মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে। লক্ষ্যবস্তু ছিল:

  • সানা: হুথিদের সদর দপ্তর, অস্ত্র গুদাম, এবং কমান্ড সেন্টার।
  • হোদাইদাহ বন্দর: ইরান থেকে অস্ত্র আনার প্রধান রুট।
  • ধামার ও সাদা: বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ড্রোন ঘাঁটি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হামলায় ৩৭ জন নিহত, যার হুথি যোদ্ধা। তবে বেসামরিক হতাহতের অভিযোগও উঠেছে।

ইরান ও আঞ্চলিক শক্তির প্রতিক্রিয়া

  • ইরান: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মার্কিন হামলা ইয়েমেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন। এটি অস্থিতিশীলতা বাড়াবে।” গোপনে হুথিদের অস্ত্র অব্যাহত রাখার ইঙ্গিত দিয়েছে তেহরান।
  • সৌদি আরব: ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত থাকলেও তারা ইরানের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যস্ত। রিয়াদ চায় কূটনৈতিক সমাধান।
  • ইসরাইল: আনুষ্ঠানিক মন্তব্য এড়ালেও গোপনে মার্কিন অভিযানকে সমর্থন করছে।

ভারতের জন্য ঝুঁকি ও প্রস্তুতি

ইয়েমেন সংকট ভারতের জন্য গভীর প্রভাব রাখে:

  • বাণিজ্যিক ক্ষতি: রেড সি রুটে ভারতের ২৫% আমদানি-রপ্তানি। জাহাজ পথ পরিবর্তনে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব ও মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে।
  • নাগরিক নিরাপত্তা: ২০২৩ সালে হুথি হামলায় আটকা পড়া ভারতীয় নাবিকদের INS কোচি উদ্ধার করেছিল। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার সম্ভাবনায় নৌবাহিনী সতর্ক।
  • জ্বালানি নিরাপত্তা: ভারত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৮৫% তেল আমদানি করে। রেড সি অস্থিরতা সরাসরি তেলের দাম বাড়াবে, যা মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভক্তি

  • জাতিসংঘ: মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুদ্ধবিরতি ও সংলাদের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা-রাশিয়ার ভেটোয় কার্যকর উদ্যোগ অসম্ভব।
  • ইইউ: অপারেশন অ্যাস্পাইডেস নামে নৌমিশন শুরু করেছে, কিন্তু হুথি ড্রোন ঠেকানোয় ব্যর্থ।
  • চীন-রাশিয়া: আমেরিকার “একতরফা সামরিক পদক্ষেপ” নিন্দা করেছে, কিন্তু ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক জটিল।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ১৯৬৭ থেকে আজকের ইয়েমেন

১৯৬৭ সালে দক্ষিণ ইয়েমেন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয়। ১৯৯০ সালে উত্তর-দক্ষিণ একত্রিত হলেও গোত্রীয় দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় বিভাজন (শিয়া-সুন্নি), এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপে দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আজ ইয়েমেনের ৮০% জনগণ মানবিক সাহায্য নির্ভর, ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: শান্তি নাকি যুদ্ধের বিস্তার?

বিশ্লেষকদের মতে, দুই দিক সম্ভাবনা:

  1. হুথিদের দুর্বলতা: মার্কিন চাপে সাময়িক পশ্চাদপসরণ। কিন্তু ইরানের থাকলে তারা গেরিলা হামলা চালিয়ে যাবে।
  2. আঞ্চলিক যুদ্ধের বিস্তার: যদি ইরান সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তবে সংঘাত ছড়াবে লেবানন, ইরাক, পারস্য উপসাগরে।

উপসংহার: অন্ধকারে ঢাকা ইয়েমেনের ভবিষ্যৎ

মধ্য প্রাচ্য আজ এক জটিল কূটনৈতিক মাইনফিল্ড। ইয়েমেনে মার্কিন হামলা এই অঞ্চলে আমেরিকা-ইরান টানাপোড়েনের নতুন অধ্যায় খুলেছে। ট্রাম্পের “শক্তি প্রদর্শন” হয়তো হুথিদের থামাবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি নতুন সহিংসতার দরজা খুলে দিতে পারে। বিশ্বের চোখ এখন ইরানের হুথিদের প্রতিশোধ, এবং রেড সি-র নৌপথের দিকে।

যুদ্ধের আসল মূল্য দিচ্ছে ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ—যাদের কণ্ঠস্বর আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপেক্ষিত। শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প না থাকলেও, ক্ষমতার রাজনীতিতে তা অধরা থেকে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *