ভারতে বেকারত্ব: বর্তমান পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জসমূহ
ভারত, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলির মধ্যে একটি, তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তবে এর অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও, বেকারত্ব এখনো একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বিশেষ করে, যুবক ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে বেকারত্বের হার অত্যন্ত উচ্চ, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি উদ্যোগ, নীতি এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করা হলেও, বেকারত্বের হার এখনও উদ্বেগজনক। ভারতের শ্রম বাজারে বেকারত্বের সমস্যা শুধু একটি অর্থনৈতিক সংকট নয়, এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও একটি বৃহৎ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি দেশের কর্মক্ষম জনগণের অব্যবহৃত শক্তিকে নষ্ট করছে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
ভারতের বেকারত্বের পরিস্থিতি এমন একটি জটিল সমস্যা, যার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল—শিক্ষিত যুবকদের চাকরি খুঁজে পাওয়া এবং সেই সাথে দেশে গড়ে ওঠা নানা অস্থিরতা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভারতের বেকারত্বের হার ছিল ৭%, তবে বাস্তবে এই হার আরও বেশি হতে পারে। বিশেষত যুবকরা, বিশেষত ১৫ থেকে ২৪ বছরের বয়সী জনগণের মধ্যে, বেকারত্বের হার মারাত্মকভাবে উচ্চ।
বেকারত্বের বর্তমান পরিস্থিতি
ভারতে বেকারত্বের হার সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কিছুটা কমলেও, বিশেষত যুবক শ্রেণির মধ্যে এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। ভারতীয় অর্থনীতি বৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্বের এই অনুপাত উন্নতির দিকে যাচ্ছে না। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে ভারতের বেকারত্বের হার ৭% ছিল, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত হার আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক বেকার ব্যক্তি লিপিবদ্ধ হয় না। দেশটির একটি বড় অংশের শ্রমশক্তি এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে, এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশের কাজ অস্থায়ী এবং অস্থির।
আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, যুবকরা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। দেশের শিক্ষিত যুবকরা উচ্চ শিক্ষা শেষ করলেও প্রয়োজনীয় স্কিলের অভাবে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত কাজ পেতে পারছে না। দেশে সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব, উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের মধ্যে সংযোগের অভাব, এবং আঞ্চলিক বৈষম্য এসব মিলিয়ে বেকারত্বের হার আরও বাড়াচ্ছে। বিশেষত, উত্তর-প্রাচ্যের রাজ্যগুলিতে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। এতে করে অনেক দক্ষ যুবকও সঠিক কর্মসংস্থান পেতে পারছে না, যার কারণে তাদের কর্মসংস্থান চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
যুবক বেকারত্ব: একটি বড় উদ্বেগ
ভারতে যুবক বেকারত্বের হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ১৫-২৪ বছরের বয়সী যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩০% এর কাছাকাছি, যা দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। ভারতীয় যুবকরা খুবই উচ্চশিক্ষিত, তবে তারা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সুযোগ পাচ্ছে না। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩০%-এরও বেশি ছিল। এই উচ্চ বেকারত্বের প্রধান কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হল—অর্থনীতির ভিতরে সৃষ্টির হার, দক্ষতার অভাব, এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অক্ষমতা।
যুবক বেকারত্বের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো—বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, একদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি দ্রুত হচ্ছে না, অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এমন কোনো উপাদান নেই, যা ছাত্রদের কর্মক্ষেত্রে দক্ষ করে তুলতে সাহায্য করতে পারে। অনেক শিক্ষিত যুবক প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ভালো ফলাফল অর্জন করলেও বাস্তবে চাকরি বাজারে তাদের জন্য সঠিক সুযোগের অভাব দেখা যাচ্ছে। এর ফলে, তারা পেশাদার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না, যার কারণে তাদের কর্মসংস্থান সমস্যা আরও জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া, ভারতের শ্রম বাজারে নানা ধরনের অসামঞ্জস্য এবং তহবিলের অভাবও এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
শিক্ষা ব্যবস্থা এবং দক্ষতা উন্নয়ন
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা, যদিও প্রচুর পরিমাণে শিক্ষার্থী তৈরি করছে, তবে তা কর্মসংস্থানে যোগ্য প্রার্থী তৈরি করতে পারে না। শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক শিক্ষা লাভ করে, কিন্তু তাদের হাতে কোনও উপযুক্ত কর্মক্ষমতা বা স্কিল থাকে না, যা তাদের চাকরি খুঁজতে সহায়ক হতে পারে। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতি প্রয়োজন, যাতে দক্ষতা উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেমন—কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং এবং সাইবার সিকিউরিটি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ভারত সরকারের “স্কিল ইন্ডিয়া” প্রোগ্রামের মতো নানা উদ্যোগ রয়েছে, তবে সেগুলি আরো কার্যকর করতে হবে। সঠিক প্রশিক্ষণ না হলে এবং কেবলমাত্র তাত্ত্বিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রশিক্ষণ না দিলে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোন সুফল আসবে না। বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে, শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন কাঠামো এবং প্রচেষ্টা তৈরি করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি একটি প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: সরকারি উদ্যোগ এবং সমাধান
ভারতের সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বেকারত্বের হার কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু প্রধান উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে—”স্টার্টআপ ইন্ডিয়া”, “মুদ্রা যোজনা”, এবং “আত্মনির্ভর ভারত” প্রোগ্রাম। এই উদ্যোগগুলো সরকারের লক্ষ্যে তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান এবং স্থানীয় ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, সরকার ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পগুলির জন্য নানা স্কিমও চালু করেছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এসব প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে হতে পারেনি, কারণ এখানকার সঠিক পরিকাঠামো এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানে সমস্যা রয়েছে। কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি এবং দেশব্যাপী এ উদ্যোগগুলির কার্যকারিতা বাড়াতে আরও শক্তিশালী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বেসরকারি খাত এবং প্রযুক্তি: সম্ভাবনার ক্ষেত্র
ভারতে বেসরকারি খাত এবং প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় সম্ভাবনা রয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সহ বিভিন্ন সেক্টরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, এবং তরুণরা ফ্রিল্যান্সিং বা প্রযুক্তিগত পেশায় প্রবেশ করছে।
বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির প্রসারের ফলে ভারতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনকারী যুবকদের জন্য এই খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। তবে, যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই খাতে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে সরকার এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমাধানের পথ
ভারতের বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা শুধুমাত্র শ্রম বাজারের দিক থেকে নয়, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রদান করবে। এই সমস্যাটি মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন স্তরে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে যুবকরা দক্ষতা অর্জন করতে পারে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য কমানো যায় এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।
প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে, শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক শিক্ষা থেকে বেশি করে প্রাকটিক্যাল স্কিল বা দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, যেমন: কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ইত্যাদি শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের কাজের জন্য প্রস্তুত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বে, বিভিন্ন উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপ প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, মুদ্রা যোজনা, এবং আত্মনির্ভর ভারত প্রোগ্রামের মতো উদ্যোগগুলো এই পথেই একটি ভালো দৃষ্টান্ত। তবে, এর কার্যকর বাস্তবায়ন এবং পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উদ্যোক্তা তৈরি করতে সরকারকে আরো উদার হতে হবে, এবং তারা যাতে সহজেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে তার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি খাত এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। আইটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ইত্যাদি খাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় তরুণরা এই খাতগুলিতে ব্যাপকভাবে সাফল্য অর্জন করতে পারে, তবে এজন্য তাদের আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই খাতে দক্ষ প্রশিক্ষণ প্রদান করার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে।
এছাড়া, কৃষি খাতের আধুনিকীকরণও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতীয় গ্রামীণ এলাকায় কৃষি এখনও একটি প্রধান শিল্প। কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিশালী করা গেলে সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে।
সবশেষে, বেকারত্ব সমস্যার একটি সমাধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্পের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিল্পের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া, এবং চাকরি বাজারের জন্য উপযুক্ত কর্মী তৈরি করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি, সমাজে দক্ষ এবং কর্মক্ষম যুবকের উপস্থিতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
এভাবে, বিভিন্ন দিক থেকে একসঙ্গে কাজ করে, ভারতের বেকারত্বের সমস্যার সমাধান সম্ভব।