প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী অভিষেক বাজের করুণ পরিণতি: পার্কিং বিবাদে প্রাণহানি
প্রশান্ত ধবনের একটি ভিডিও থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আজ আমরা আলোচনা করব এক প্রতিভাবান ভারতীয় বিজ্ঞানীর জীবন ও মৃত্যুর করুণ কাহিনী নিয়ে। অভিষেক বাজ, যিনি সিলভার ন্যানো পার্টিকেল গবেষণায় বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এক তুচ্ছ পার্কিং বিবাদের বলি হয়ে প্রাণ হারান। তাঁর এই অকাল মৃত্যু সমগ্র দেশকে নাড়া দিয়েছে এবং সমাজে আইনের শাসন, নাগরিক সচেতনতা ও বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
অভিষেক বাজ: এক উজ্জ্বল মেধার পরিচয়
অভিষেক বাজ ছিলেন এক অনন্য মেধাবী বিজ্ঞানী, যিনি সিলভার ন্যানো পার্টিকেলস গবেষণায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিলেন। সিলভার ন্যানো পার্টিকেল প্রযুক্তি নতুন প্রজন্মের শক্তি উত্স, বিশেষত সৌরশক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। অভিষেক বাজের গবেষণায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে উন্নত ভবিষ্যতের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
তিনি তাঁর গবেষণায় সাফল্য অর্জন করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান জার্নালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ একাধিক দেশে তাঁর ১০০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তিনি ভারতের আইআইএসইআর (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)-এ গবেষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন এবং দেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
স্বাস্থ্যগত সমস্যার মধ্যেও তিনি তাঁর গবেষণায় অবদান রেখেছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর পরও, কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর গবেষণা থেমে যায়নি। তবে, কোনোভাবেই তিনি জানতেন না যে, এক অল্পসময়ের পর তাঁর জীবন শেষ হয়ে যাবে এক অবাঞ্ছিত ঘটনার মধ্যে, যা ছিল এক তুচ্ছ পার্কিং বিবাদ।
পার্কিং বিবাদ: কিভাবে ঘটল মৃত্যু?
অভিষেক বাজের মৃত্যুর কারণ ছিল একটি সাধারণ পার্কিং বিবাদ, যা অতিরিক্ত উত্তেজনা ও সহনশীলতার অভাবে একটি মর্মান্তিক পরিণতি ঘটায়। তিনি মোহালির সেক্টর ৬৭-এর একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন, যেখানে তাঁর প্রতিবেশীর সঙ্গে পার্কিং নিয়ে কিছুদিন ধরে মতবিরোধ চলছিল। প্রতিবেশী একটি নির্দিষ্ট স্থানে তার গাড়ি পার্ক করার জন্য বারবার অভিযোগ করতেন যে অভিষেকের বাইক তার স্থানে পার্ক করা হচ্ছে।
২০২৩ সালে এই বিষয়টি নিয়ে দু’জনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। প্রতিবেশী, যার সঙ্গে অভিষেকের বিরোধ চলছিল, রেগে গিয়ে অভিষেককে লাথি মারে। এই আক্রমণের ফলস্বরূপ, অভিষেক গুরুতর আহত হন এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে আক্রমণকারী অভিষেককে ধাক্কা দিচ্ছেন, এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে, অভিষেক এ ঘটনার শিকার হয়ে নিজের প্রাণ হারান।
সমাজে ক্রমাগত হ্রাসমান সহনশীলতা: কোথায় গেল মানবতা?
অভিষেক বাজের মৃত্যু শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি আমাদের সমাজের রূঢ় বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। বর্তমান সময়ে, খুব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সহিংসতা বাড়ছে—পার্কিং, জমি, জল নিয়ে প্রতিদিন সংঘাত ও সংঘর্ষ হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা এবং ধৈর্যের অভাব দেখা যাচ্ছে, যা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
প্রশান্ত ধবনের মতে, ‘‘আজকাল মানুষের মধ্যে অপরাধবোধ এবং সহনশীলতার অভাব বেড়েই চলেছে, যা প্রতিদিনের ছোটখাটো বিষয়গুলোকেও সহিংসতায় রূপান্তরিত করছে।” এই ঘটনার মাধ্যমে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমাদের সমাজে নাগরিক দায়িত্ববোধের অভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেকেই এমনভাবে আচরণ করছেন যেন তারা নিজেদের শক্তি বা কর্তৃত্বের প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পেলে সেটি ছাড়বে না।
অভিষেক বাজের নাম অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও, তার মৃত্যুতে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশে এক বিজ্ঞানী এত বড় সাফল্য অর্জন করলেন, সেই দেশে তার মৃত্যুর পরেও কতজন এই নামটি জানেন না—এটা এক কঠিন প্রশ্ন।
বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা: রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী?
অভিষেক বাজের মতো মেধাবী একজন বিজ্ঞানী যদি আন্তর্জাতিক স্তরে তার গবেষণা চালিয়ে যান, তবে তাঁর গবেষণার প্রশংসা পেতেন এবং আরও বড় সাফল্য অর্জন করতেন। কিন্তু তিনি নিজের দেশের প্রতি বিশ্বাস রেখে ভারতেই গবেষণা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুতরাং, প্রশ্ন উঠছে—কেন আমাদের দেশ এমন একজন মেধাবী বিজ্ঞানীকে রক্ষা করতে পারল না?
অভিষেকের মতো বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা এবং আবাসনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। সরকারের উচিত ছিল তাঁর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে তিনি কোনো ধরণের হুমকির সম্মুখীন না হন।
আইআইএসইআর-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘আমরা এক উজ্জ্বল মস্তিষ্ককে হারালাম, যিনি ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের ভবিষ্যৎ তৈরি করার স্বপ্ন দেখছিলেন।’’ এমন একজন বিজ্ঞানী, যিনি ভারতের জ্ঞানভান্ডারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন, তার অকাল মৃত্যু দেশের জন্য এক বড় আঘাত।
আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতা: পুলিশিং সংস্কার জরুরি
ভারতের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ায়, এমন ধরনের ঘটনাগুলি বারবার ঘটতে দেখা যায়। ভারতের পুলিশ বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে, কারণ পুলিশ সদস্যের সংখ্যা প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ১৫৪ জন, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের (২২২ জন) তুলনায় অনেক কম।
এছাড়া পুলিশের জবাবদিহিতা এবং দক্ষতার অভাবও একটি বড় সমস্যা। আক্রমণকারীকে দ্রুত গ্রেফতার করা হলেও, এই ধরনের সহিংসতা রোধ করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আহ্বান: সিনেমা থেকে শুরু হোক
বর্তমান সময়ে সিনেমাগুলি সমাজের আচরণে বিশেষ প্রভাব ফেলে। সিনেমাগুলিতে প্রায়শই হিরোদের হিংসাত্মক আচরণ যেমন—ধাক্কা দেয়া, লাথি মারা—রোমান্টিকাইজ করা হয়। এই ধরনের দৃশ্য যুবসমাজের মধ্যে সহিংসতার প্রবণতা তৈরি করতে পারে। সমাজের আচরণ পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যম এবং বিনোদন শিল্পের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
প্রশান্ত ধবনের মতে, ‘‘সিনেমাগুলিতে হিংসাত্মক দৃশ্যগুলো গ্ল্যামারাইজ না করে নাগরিক দায়িত্ববোধের বার্তা প্রচার করা উচিত।’’
উপসংহার: অভিষেকের উত্তরাধিকার
অভিষেক বাজের মৃত্যু আমাদের সবাইকে এক কঠিন শিক্ষা দিয়েছে। তাঁর মতো মেধাবীদের রক্ষা করতে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। তাঁর মৃত্যু যেন অকারণে না হয়, তাই আমাদের উচিত সমাজে শান্তি, সহনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। অভিষেকের গবেষণা যেন থেমে না থাকে, সে জন্য আমাদের উচিত তাঁর কাজকে সম্মান জানানো এবং তার কাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
অভিষেক বাজের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য, আমাদের একত্রিত হয়ে সমাজে মানবিকতা, দায়িত্ববোধ এবং আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ওম শান্তি।